Showing posts with label উপন্যাস. Show all posts
Showing posts with label উপন্যাস. Show all posts

Tuesday, January 8, 2019

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান। শেষ পর্ব।

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান। শেষ পর্ব।

ন্যান্সি আর ডেভ বাড়িতে পৌঁছে। ড্রয়িং রুমে গিয়ে ঘড়ি দেখে। রাত সাড়ে নয়টা বাজে। ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সাড়ে আটটায়। এই এক ঘণ্টার মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। এখন দ্রুত পুলিশকে সব জানাতে হবে। দাদুর ঘরের দিকে তাকায়। আলো নেই। তার মানে দাদু-দাদি শুয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়েও গেছেন হয়ত। কিন্তু উপায় নেই। দেরি করা যাবে না। দু’জন ছুটে গিয়ে দাঁড়ায় দরজার সামনে। ন্যান্সি আস্তে নক করে। আবার। তারপর আবার। দাদুর গলা শোনা যায়-
: কে?
: দাদু আমি ন্যান্সি। দরজা খুলুন।
একটু সময় কাটে। দরজা খোলেন দাদু। বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন-
: কী ব্যাপার? তোমরা? ডাকছ কেন?
: হ্যাঁ দাদু, একটু সমস্যা হয়েছে। আপনি শিগগির পুলিশকে ফোন করুন। তারা যেন আপনার এখানে এখুনি চলে আসে।
: পুলিশকে ফোন! কিন্তু কেন? কী হয়েছে? কুর্ট কোথায়?
এতগুলো প্রশ্ন করে ফেলেন দাদু একসাথে। ন্যান্সি বলে-
: দাদু প্লিজ, আমার কথা আগে শুনুন। আপনি পুলিশকে ফোন করে দ্রুত আসতে বলুন। জরুরি। তারা আসার পর সব খুলে বলব আমি। দয়া করে দেরি করবেন না।
ন্যান্সির কথায় দ্রুত ড্রয়িং রুমে গিয়ে পুলিশকে ফোন করলেন দাদু। জরুরি ব্যাপার বলে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন অফিসারকে। তারপর বেরিয়ে এলেন। এদিকে দাদিও উঠে এসেছেন। পুলিশ আসছে শুনে কিচেনে কফি তৈরি করতে যাচ্ছেন বলে বেরিয়ে গেলেন। ডেভ গেল তাকে সাহায্য করতে।
আট মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলেন পুলিশের সহকারী কমিশনার জন হপকিন্স। দাদুকে আগে থেকেই চেনেন তিনি। তার সাথে আরো তিনজন অফিসার রয়েছেন। তাদের স্বাগত জানিয়ে দাদু ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালেন। ন্যান্সিকে দেখিয়ে বললেন-
: এ আমার নাতনি ন্যান্সি। সে কিছু জরুরি কথা বলতে চায় আপনাদের।
হপকিন্স অবাক হয়ে চাইলেন ন্যান্সির দিকে। ন্যান্সি বিলম্ব না করে সকালে তাদের গুহায় যাওয়া, লিনের আটক হওয়া, তারপর রাতে অভিযানে বেরনো, মাদক চক্রের নেতার মাদক চালান পাঠানোর প্ল্যান, তাদের এক সদস্যকে আটক করা, গুপ্তধনের কথা সংক্ষেপে জানায়। বিস্মিত অফিসার জিজ্ঞেস করলেন-
: তুমি বলছ যে কুর্ট আর লিন এখনো গুহার মধ্যেই আছে?
: হ্যাঁ, ওরা আপনাদের অপেক্ষায় আছে।
হপকিন্স বললেন-
: তাহলে আর দেরি করা ঠিক হবে না।
এদিকে কফি এসে গেছে। এখন কফি খাওয়ার সময় নয়। কিন্তু দাদির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সবাই কাপ হাতে তুলে নিলেন। এর মধ্যেই ওয়াকিটকিতে দু’ জায়গায় কথা সেরে নিলেন হপকিন্স। কফি খাওয়া শেষ হলো তিন মিনিটে। তারপর দাদুর কাছ থেকে বাড়ির সামনে রাস্তা ও গুহার সাথে সংযোগের লোকেশনটা জেনে নিলেন তিনি। অফিসে ডিউটি অফিসারকে এ বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দশজনের একটা পুলিশ টিম পাঠিয়ে দিতে বললেন তখুনি। তিন অফিসারের মধ্যে একজনকে বললেন-
: অফিসার ন্যাশফিল্ড, আপনারা তিনজন ন্যান্সিদের সাথে বাড়ির পেছন দিয়ে যান। আমি পুলিশ টিম এলে তাদের নিয়ে রাস্তার দিক দিয়ে গুহায় ঢুকব। সাবধান থাকবেন। ওয়াকিটকিতে আমাদের যোগাযোগ থাকবে।
দেরি না করে পুলিশদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ন্যান্সি।
এদিকে বেশ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল কুর্ট। মাদক চক্রের সদস্য যে লোকটিকে ওরা আটকে রেখেছে তার নাম পেন্স। ন্যান্সি আর ডেভ চলে যাওয়ায় কুর্টদেরকে মাত্র দু’জন দেখে সে মনে মনে খুশি হয়ে উঠেছিল। দু’জন শিশু ওকে বন্দী করে রাখবে, তুলে দেবে পুলিশের হাতে এটা মানতে পারছিল না সে। এ রীতিমতো মান-সম্মানের ব্যাপার। দলের লোকদের কেউ যদি জানতে পারে, তারা তাকে নিয়ে উপহাস করবে। কিন্তু একবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় পালানোর চিন্তা বাদই দিয়েছিল সে। এখন আবার চিন্তাটা মাথায় বাসা বাঁধে। সমস্যা হলো, হাত দুটো ছেলেটা পেছনে এমনভাবে বেঁধেছে সে কিছু করার কোনো সুযোগই পাচ্ছে না। তার ওপর ছেলেমেয়ে দুটো খুব কড়া নজর রেখেছে তার ওপরে। বাড়াবাড়ি করলে বিপদ হতে পারে। ছেলেটাকে বিচ্ছুর মত মনে হয়। গুলি করার ভয় দেখিয়েছে। এবার হয়ত গুলিই করে বসবে।
কুর্ট আর লিন নিজেদের মধ্যে কী ব্যাপারে যেন আলোচনা করছে। পেন্সের দিকে নজর নেই। সুযোগটা নেয় পেন্স। নিঃশব্দে পাথরটার কোণের দিকে সরতে থাকে। সরতে সরতে পাথরটার মাথায় পৌঁছে যায়। সামনেই গুহার প্রশস্ত জায়গা। পেট্রোম্যাক্সের আলো জ্বলছে। সে সময় জ্যাককে দেখতে পায়। এদিকেই আসছে। সেই যে গুপ্তধনের গুহায় দৌড়ে যেতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে সে ধরা পড়ল, সে সময় তার সাথে থাকা জ্যাক পালিয়ে গিয়েছিল। পেন্স মনে করেছিল সে দলের বাকিদের কাছে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা সে যায়নি। বরং এতক্ষণ কোথাও হয়ত লুকিয়ে ছিল। তারপর কারো কোনো সাড়া না পেয়ে হয়ত এখানে ফিরে এসেছে। হঠাৎ জ্যাক তাকে দেখতে পায়। চিৎকার করে ওঠে সে-
: এই পেন্স! তুমি কি করছে ওখানে বসে?
ছুটে আসে সে তার কাছে। মেঝেতে বসে পড়ে তার হাতের বাঁধন খুলতে যায়। কিন্তু তা আর হয় না। কানের পাশে পিস্তলের স্পর্শে জমে যায় জ্যাক। হাত থেমে যায় তার। ভুল করে ফেলেছে সে। পিস্তলধারীর চেহারাও দেখা হয়ে গেছে। সেই বিচ্ছু ছেলেটা। তার সাথে একটি মেয়েও আছে। মেয়েটির হাতে একটি মাঝারি সাইজের কাঠ। আঘাত করতে তৈরি।
কুর্ট কঠিন স্বরে বলে-
: নড়ো না বাপু। সাবধান। আমার পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়ে যেতে পারে।
লিনকে বলে-
: শয়তান দুটোকে আমি দেখছি। তুই একগাছা দড়ি আন তো।
ড্রাগনের দিকে ইশারা করে কুর্ট। লিন ড্রাগনের দিকে এগোয়। ড্রাগনের সে কাঠের আগুন নিভে গিয়েছিল। লিন এক পাশ থেকে একটি দড়ি খুলে আনে। তার কাছ থেকে দড়ি নিয়ে কুর্ট বলে-
: আমি এ লোকটাকে বাঁধছি। তুই পিস্তলটা নে। কেউ নড়লে সাথে সাথে সাথে তার মাথায় গুলি করবি।
দড়িটা একটু চিকন হলেও বড় ছিল। আগে জ্যাকের হাত পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলে। এ সময় তার নাম জানতে চায় কুর্ট। কোনো জবাব মেলে না। লিন পিস্তল দিয়ে মাথায় একটা গুঁতো দিতেই অবশ্য ফল মেলে। অনিচ্ছার সাথে নামটি বলে সে- জ্যাক। পেন্সের দিকে ইঙ্গিত করে কুর্ট-
: ওর নাম কী?
: পেন্স।
কুর্ট বলে-
: বা! এই তো ভালো লোক। পুলিশ আসছে। তোমরা যদি আমাদের সাথে কোনো ঝামেলা না কর আর তথ্য দিয়ে সহায়তা কর, সেটা তোমাদের জন্য ভালো হবে। তাহলে তোমাদের পক্ষে আমরা দু-একটা কথা বলব যাতে অন্যদের চেয়ে শাস্তি কম হয়।
: রাখো তোমার শাস্তি! বলে ওঠে জ্যাক- আমাদের বস গুপ্তধনের গুহা থেকে এখনি ফিরবে। তখন কে বাঁচাবে তোমাদের?
জবাবে জ্যাকের পা ভালো করে বাঁধে কুর্ট। তাকে বসিয়ে দেয় পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে। তারপর তার কাছ থেকে প্রায় পাঁচ হাত দূরে সরিয়ে নেয় পেন্সকে। জ্যাকের বিপরীত দিকে মুখ করে বসায় তাকে যাতে দু’জন কোনো কথা বলতে না পারে। এবার লিনের কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে জ্যাকের পাশে দাঁড়ায়। লিন যথারীতি দাঁড়ায় গিয়ে পেন্সের পাশে। বলে-
: আচ্ছা দেখা যাক, কে কাকে বাঁচায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে পড়বে।
পেন্স যখন ধীরে পাথরের এ প্রান্তে সরে আসছিল তখন লিনের সাথে কথা বলছিল কুর্ট। হঠাৎই তার সতর্ক চোখের কোণে হাত বাঁধা লোকটির ধীর নড়াচড়া চোখে পড়ে। মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ায়। সে সময় পাথরের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া পেন্সের উদ্দেশ্যে জ্যাকের চিৎকার শোনা যায়। আয় লিন- বলেই সে তিন লাফে পৌঁছে যায় পেন্সের কাছে। তারপর পিস্তল তাক করে কাবু করে জ্যাককে।

৭.
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বন্দী দু’জনের দিকে কড়া নজর রেখেছে কুর্ট আর লিন। অপেক্ষা করছে কখন পুলিশ নিয়ে আসে ন্যান্সি। আচ্ছা, ওরা কি ঠিকমত বাড়ি যেত পেরেছে, দাদুকে ডেকে তুলে তাকে দিয়ে পুলিশকে টেলিফোন করাতে পেরেছে? পুলিশ কি এসেছে? কথা বলেছে ওদের সাথে? ওরা কি পুলিশকে ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে পেরেছে? কুর্টের মাথায় নানা চিন্তা ঘুরতে থাকে। এদিকে মনের ভেতর একট চাপা শঙ্কা কাজ করছে। গুপ্তধনের খোঁজে যাওয়া মাদক চক্রের নেতা ও তার সাথীরা যদি পুলিশ আসার আগেই ফিরে আসে তখন কি হবে? সে ও লিন তাদের অতগুলো লোককে কাবু করতে করতে পারবে না। সে প্রশ্নই আসে না। এখানে বিপুল পরিমাণ হেরোইন ও কোকেন রয়েছে। এই ভয়ঙ্কর মাদক পাচারের কাজ করছে এ লোকগুলো। তারা বহু টাকা আয় করছে এর মাধ্যমে, কিন্তু চরম ক্ষতি করছে মানুষের। বিশেষ করে কিশোর-তরুণরাও এখন মাদকের নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে। আর মূল্য যাই হোক, সব জায়গাতেই মাদক মেলে। এত আইন, এত কড়াকড়ি- তার মধ্যেও মাদক ব্যবসা কিভাবে চলে তা এক বিরাট রহস্য। কুর্ট নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে। সব না হলেও অনেক খবরই রাখে সে। সে অনুমান করে যে এই নির্জন সমুদ্রসৈকতের গুহাগুলো বেছে নেয়ার কারণ আছে। বিশেষ যোগাযোগের মাধ্যমে এই মাদক চক্র জাহাজের মাধ্যমে এগুলো আনে। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পথ। জাহাজ থেকে কার্টন নামিয়ে বোটে করে এগুলো এখানে এনে স্টক করে। তারপর চাহিদামত সড়ক বা রেলপথে বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। তবে ধারা পড়ার ভয়ে তারা একসাথে বেশি পরিমাণ মাদক কখনো পাঠায় না। কে জানে এরা কতদিন ধরে এ কাজ করছে আর কত তরুণ-কিশোরের জীবন ধ্বংস করে তাদের ও তাদের বাবা-মাদের সকল স্বপ্ন নষ্ট করে দিচ্ছে।
হঠাৎ খড়খড় আওয়াজ কানে আসতেই চমকে ওঠে সে। কি ব্যাপার? পর মুহূর্তেই টর্চের আলোর উদ্ভাস চোখে পড়ে। এ সময় গুহাপথে ওয়াকিটকিতে কথা শোনা যায়। কে যেন জিজ্ঞেস করছে- রজার বলছি। তোমরা কি পৌঁছে গেছ? এদিক থেকে জবাব দেয় কেউ- চার্লি বলছি। আমরা গুহায় পৌঁছে গেছি।
এ সময় ওদের কাছে দৌড়ে আসে ন্যান্সি আর ডেভ। তাদের সাথে তিনজন পুলিশ অফিসার। ন্যান্সি কুর্টকে বলে-
: ঠিক আছিস তো তোরা?
তার জবাবের অপেক্ষা না করে কুর্টকে টেনে নিয়ে যায় ইন্সপেক্টর ন্যাশফিল্ডের দিকে। পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের-
: মি. ন্যাশফিল্ড! এই হচ্ছে কুর্ট। আর কুর্ট, ইনি অফিসার ন্যাশফিল্ড।
ন্যাশফিল্ড কুর্টের কাছ থেকে সংক্ষেপে সম্পূর্ণ পরিস্থিতির একটি ধারণা নেন। মাদক চক্রের আটক দু’ সদস্যকে দেখিয়ে দেয় সে। সঙ্গী অফিসাররা দু’জনের বাঁধন খুলে হাতকড়া পরিয়ে দেন। সবাই গিয়ে জড়ো হয়। বড় গুহায়। এর মধ্যে হপকিন্সও পৌঁছে যান। এক নজর দেখেই কুর্টকে চিনে ফেলেন তিনি। কেউ পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগেই তার কাছে এগিয়ে যান-
: হ্যালো ব্রেভ বয়! আমি পুলিশের সহকারী কমিশনার জন হপকিন্স। ঠিক আছ তো তুমি?
জবাবে মাথা নাড়ে কুর্ট। হপকিন্স হ্যান্ডশেক করেন তার সাথে। পুলিশ অফিসারের হাতে বেশ জোর আছে, বুঝতে পারে কুর্ট। এ সময় তার চোখ পড়ে হাতকড়া পরানো মাদক চক্রের আরো দু’সদস্যের দিকে। আরে, এ দু’জন না ড্রাগন দেখে পালিয়ে গিয়োছিল! কুর্টকে তাদের দিকে অবাক চোখে চাইতে দেখে হপকিন্স বলেন-
: ওদের আমরা রাস্তার দিকে গুহার প্রবেশপথ থেকে আটক করেছি। এখন এখানে কি অবস্থা বল।
কুর্ট তাকে গোটা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। ইঙ্গিতে দেয়ালের গায়ে সারি দিয়ে রাখা কোকেন ও হেরোইনের প্যাকেটগুলো দেখায়। কয়েকজন পুলিশ অফিসার ছুটে যান সেদিকে।
এবার আসল সমস্যা। তা হলো, মাদক চক্রের নেতাসহ তার গোটা দলকে আটক করা। কুর্টের কাছ থেকে গুপ্তধনের গুহার দিকে যাওয়ার পথটা জেনে নেন হপকিন্স। দু’জন পুলিশকে গুহাপথে একটু এগিয়ে গিয়ে অবস্থান নেয়ার জন্য বললেন তিনি। এদিকে একটু কাজ সারবেন তিনি। ততক্ষণে মাদক চক্রের লোকজন যদি ফিরে আসে তাহলে সতর্ক করে দেবে তারা।
চার বন্দীকে ঘিরে ধরে পুলিশরা। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে তাদের। কঠিন স্বরে হপকিন্স বলেন-
: পরিস্থিতিটা তোমরা বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই। অতএব কৌশল খাটানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না। আপাতত অল্প কিছু প্রশ্নের জবাব দাও।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এ মাদক চক্রের সব খোঁজখবর জানা হয়ে গেল। এ মাদক চক্রের নাম ডেল্টা কার্টেল। তাদের নেতার আসল নাম জানে না কেউ, নিরাপত্তার স্বার্থেই নাকি জানানো হয় না। সবাই তাকে রেড অ্যারো বলে জানে। ডাকে বস বলে। এবার কুর্ট জিজ্ঞেস করে-
: আচ্ছা, গুপ্তধনের ব্যাপারটা কী?
চারজনের মধ্যে একজন মাত্র ব্যাপারটা বলতে পারল। সে যা শুনেছে সে গল্পটি এই যে, আঠারো শতকের মাঝামাঝি জলদস্যুদের একটি দল বিভিন্ন জাহাজ থেকে লুণ্ঠন করা ধনরত্ন নিয়ে ঘটনাচক্রে এ সৈকতের কাছে এসে পৌঁছে। তখন এদিকে লোক বসতি ছিল না। জলদস্যু নেতা ধনরত্নগুলো এখানকার গুহার ভেতরে আপাতত লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা এ গুহাটি নির্বাচন করে। কারণ, এ গুহাটি ছিল বিরাট। আর এর ভেতরে ছিল আরে কিছু গুহা যা সাধারণত দেখা যায় না। একটি ছোট গুহা বেছে নেয় তারা। তার মেঝে খুঁড়ে ধনরত্নগুলো একটি বড় আবলুস কাঠের বাক্সে ভরে মাটি চাপা দেয়া হয়। আবলুস কাঠ সহজে পচে না। মোট পাঁচজন জলদস্যু এ বিষয়টি জানত। সাথীদের নিয়ে জলদস্যু ক্যাপ্টেনের এক বছর পর এখানে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হয়নি। কিছুদিন পর ইংল্যান্ডের এক যুদ্ধ জাহাজের সাথে যুদ্ধে জলদস্যু নেতাসহ অনেকে নিহত হয়। বাকিরা আটক হয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কারাগারে কাটায়। তাদের মধ্যে সেই পাঁচজনের একজনও ছিল। গুরুতর অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর কিছুদিন আগে সে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে শেষদিনগুলো কাটায়। ধারণা করা হয় যে সেই গুপ্তধনের গুহার একটি নকশা এঁকেছিল। তারপরই কিছু লোক গুপ্তধনের কথা জানতে পারে। কিন্তু কেউ তা খুঁজে পেয়েছে কিনা তা কেউ জানে না। আদৌ গুপ্তধন এখানে আছে কিনা তাও কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। এই মাদক চক্রের নেতা কিভাবে যেন এ গুপ্তধনের কথা জানতে পারে। তার কাছে নাকি গুপ্তধন যে গুহায় রাখা তার একটি হাতে আঁকা পুরনো নকশা আছে। তা নিয়ে এর আগে সে গুপ্তধনের সম্ভাব্য গুহাটি চিহ্নিত করেছে। আজ তা উদ্ধার করতে গেছে।
একটু পরই হপকিন্স তার পুলিশ দল নিয়ে কথিত গুপ্তধনের গুহার দিকে অগ্রসর হলেন। তাদের সবার হাতে শক্তিশালী টর্চ ও পিস্তল। মাদক চক্রের আটক চার সদস্যকে সামনে রাখা হলো। কুর্টদের চারজনকেও সাথে নিলেন তিনি। বলা যায় না, গোলাগুলি হতে পারে। তাই ওদেরকে রাখলেন দলের মাঝামাঝি। কারণ, তাদের অন্তত চারজনের কাছে পিস্তল আছে বলে আটক লোকগুলো জানিয়েছে। ইতোমধ্যে জেনে নিয়েছেন যে গুপ্তধনের কথিত গুহায় যাবার একটিই পথ। সে গুহা থেকে অন্যদিকে যাবার উপায় নেই। দস্যুদের যেহেতু পালানোর পথ নেই তাই তাদের আটক করতে খুব একটা সমস্যা হবে না বলেই মনে হলো তার। টর্চের আলো জ্বেলে এগোতে শুরু করলেন তারা।
দেখানো পথে কিছুটা পথ এগোতেই কয়েকজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। দু’তিনজনের হাতে মশাল। মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলেন হপকিন্স। আটক চারজনসহ পুলিশদের নিয়ে নিঃশব্দে অন্ধকারের মধ্যে একটু পিছিয়ে যান। এখানে জায়গাটি খানিকটা প্রশস্ত। চাপা গলায় খুব দ্রুত কিছু নির্দেশ দিলেন তিনি। পুলিশরা সবাই চোখের পলকে অর্ধচন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে অবস্থান নিলেন। মাঝখানে সামনে রাখা হলো চার বন্দীকে। ততক্ষণে কথা বলতে বলতে একেবারে কাছে এগিয়ে আসে মাদক চক্রের সদস্যরা। হপকিন্সের চাপা গলার নির্দেশের, সাথে সাথে পুলিশদের তেরোটি টর্চলাইট এক সাথে জ্বলে ওঠে। এতগুলো শক্তিশালী টর্চের আলোয় চারদিক দিনের আলোর মত আলো হয়ে ওঠে। হতভম্ব হয়ে পড়ে ডেল্টার সদস্যরা। গর্জে ওঠেন হপকিন্স-
: হ্যান্ডস আপ!
বিনা বাক্যব্যয়ে হাত ওপরে তোলে সবাই। সবাইকে ঘিরে ফেলেন অফিসাররা। মাদক চক্রের চারজনের হাতে পিস্তল ছিল। তাদের হাত থেকে নিয়ে নেয়া হয় সেগুলো।
রেড অ্যারোকে জিজ্ঞেস করেন হপকিন্স-
: তা মি. বস, গুপ্তধন কোথায়? খুঁজে পেয়েছ কি?
জবাব দেয় না সে। সবাইকে সার্চ করার নির্দেশ দেন হপকিন্স।
ডেল্টার দুই সদস্যের কাছে দু’টি ছুরি পাওয়া যায়। দু’জনের কোমরে গোঁজা ছিল। কিন্তু তথাকথিত গুপ্তধনের সন্ধান মেলে না। হপকিন্স বুঝতে পারেন, কোথাও কোনো গোলমাল হয়েছে। কৌতূহল বাড়ে তার। কিন্তু এরা কেউ কথা বলছে না। একটা কৌশল নেন তিনি। সবাইকে নিয়ে চলে আসেন বড় গুহাটায়। তারপর মাদক চক্রের এক সদস্যকে ঝট করে আলাদা করে ফেলেন। দু’জন অফিসারকে বলেন- সাইজ করুন ওকে।
নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে দু’জন অফিসার এগিয়ে গিয়ে জাপটে ধরেন তাকে। টেনে নিয়ে যেতে থাকেন এক কোণে। পুলিশের সাইজ করার মানে কী, সে ব্যাপারে লোকটির ধারণা আছে বোঝা গেল। ভীত গলায় বলে ওঠে সে-
: আমাকে ছেড়ে দিন। সব বলছি।
তাকে হপকিন্সের কাছে হাজির করেন অফিসাররা।
লোকটির কাছ থেকে জানা গেল, বসের নির্দেশে গুহা খোঁড়াখুঁড়ি করেছে তারা অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু কিছুই মেলেনি। মনে হয়, বসকে ভুয়া তথ্য দিয়ে ঠকিয়েছে কেউ। গুপ্তধন না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসছিল তারা। এত পরিশ্রম করেও কিছু না পাওয়ায় সবার মন-মেজাজ খারাপ। তাই সতর্কতা তেমন ছিল না তাদের। সে জন্যই ধরা পড়ে গেছে। নইলে তারা ধরা পড়ত না।
হপকিন্স বলেন-
: ধরা যখন পড়েছ তখন কপালে দুঃখ আছে। সারাজীবন আর জেল থেকে বেরোতে হবে না।
কয়েকজন অফিসার হেরোইন-কোকেনের স্তূপীকৃত প্যাকেটগুলো খুলে অকুস্থলে একটি সিজার লিস্ট তৈরি করেন। এতে কিছুটা সময় লাগে। ইতোমধ্যে ওয়াকিটকিতে পুলিশ কমিশনারকে ঘটনার একটা তাৎক্ষণিক রিপোর্ট দিয়েছেন হপকিন্স। বিশেষ করে কুর্ট ও তার খুদে বাহিনীর জন্যই যে মাদক চক্রকে ধরা সম্ভব হয়েছে সে কথা জানিয়েছেন। শুনে কমিশনার অবাক হয়ে বলেছেন, তাই নাকি?
সিজার লিস্ট তৈরি হয়ে গেছে। সব হেরোইন- কোকেনসহ কড়া পাহারায় মাদক চক্রের সদস্যদের নিয়ে রাস্তার দিকটায় বেরিয়ে আসেন হপকিন্স। এদিকে আরো কিছু পুলিশ এসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ এসকর্টসহ একটি গাড়ি এসে থামে। হপকিন্স অবাক হয়ে দেখলেন, পুলিশ কমিশনারের গাড়ি। নেমে এলেন পুলিশ কমিশনার জিম হারবার্ট। বুঝতে পারলেন, মাদক চক্রকে আটক করার খবর পেয়েই কমিশনার এসেছেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ নয় যে স্বয়ং পুলিশ কমিশনারকে আসতে হবে। ততক্ষণে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। জন হপকিন্সকে আগে থেকেই চেনেন। বললেন-
: কংগ্র্যাট হপকিন্স। আপনি ও আপনার অফিসাররা খুব ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু আমি যে জন্য এলাম, তারা কই?
মুহূর্তে হপকিন্সের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় ব্যাপারটা। তার ডাকে কুর্টরা সবাই এগিয়ে আসে কাছে। কিছুক্ষণ আগেই সে ও ন্যান্সি তাদের কাছে থাকা পিস্তল দু’টি তুলে দিয়েছে হপকিন্সের কাছে। তিনি ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন-
: এই যে স্যার! এ হচ্ছে কুর্ট, সাথে তার বাহিনীর সদস্যরা- ন্যান্সি, লিন ও ডেভ। জানেন স্যার! ওরা চারজন আপন ভাইবোন।
: তাই নাকি! অবাক হন হারবার্ট। তারপর হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দেন কুর্টের দিকে। বলেন-
: সাহসী ছেলে তুমি!
তারপর হ্যান্ডশেক করেন ন্যান্সি, লিন ও ডেভের সাথে। ডেভের দিকে চেয়ে বিস্ময়ের সাথে বলেন-
: ভয় পাওনি তুমি ইয়ং বয়!
ঝটপট উত্তর দেয় ডেভ-
: একটুও না।
৮.
সব বন্দী, আটক করা হেরোইন ও কোকেনের প্যাকেটগুলো নিয়ে পুলিশ অফিসাররা চলে গেলেন। রয়ে গেলেন কমিশনার জিম হারবার্ট, সহকারী কমিশনার জন হপকিন্স, ইন্সপেক্টর ন্যাশফিল্ড ও অন্য তিন-চারজন অফিসার। হারবার্ট বললেন-
: এবার এ সাহসী ছেলে-মেয়েগুলোকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হয়, কী বলেন মি. হপকিন্স!
: হ্যাঁ স্যার। আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি। বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
: চলুন, আমিও যাই।
খুদে বাহিনী বা গ্রুপ ফোরের সদস্যরা হপকিন্সের গাড়িতে ওঠে। সেখান থেকে তাদের দাদুর বাড়ির দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। তাই অল্পসময়ের মধ্যেই পৌঁছে যায় তারা।
গাড়ি থেকেই দাদু বাড়ির সামনে বেশ কিছু লোক চোখে পড়ে কুর্টের। এত রাতে এত লোক! সবার আগে লাফ দিয়ে নামে কুর্ট। গেটের কাছে যেতেই দাদুকে দেখতে পায় সে। উদ্বিগ্ন চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন তিনি। কুর্ট তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ন্যান্সি, লিন ও ডেভও এসে পৌঁছে। তাদের জড়িয়ে ধরেন দাদু। কুর্ট দেখে, তার গাম্ভীর্য সরে গেছে। মুখে হাসি। বলেন-
: কী কা- ঘটিয়েছ তোমরা দেখেছ? আমাদের ঘুমাতে দাওনি। প্রতিবেশীরা অনেকেই খবর জেনে চলে এসেছেন।
হাজির হন হারবার্ট ও হপকিন্স। হপকিন্স কুর্টের দাদুকে দেখিয়ে হারবার্টকে বলেন-
: স্যার! ইনি জেফ সাদারল্যান্ড। এখানকার বিশিষ্ট ব্যক্তি। এদের দাদু।
হারবার্ট করমর্দন করেন তার সাথে। বলেন-
: এ সাহসী ছেলে-মেয়েগুলো চমৎকার কাজ করেছে। পুলিশ বিভাগ ওদেরকে একটা রিসেপশন দেবে। আমরা কাল যোগাযোগ করব ওদের সাথে। ভালো থাকুন। আমরা আসছি এখন।
হপকিন্সও বিদায় নেন তার কাছ থেকে। চলে যান তারা সবাই। প্রতিবেশীরাও পা বাড়ান নিজ নিজ বাড়ির দিকে ।
: খুদে বাহিনী, চল ঘরে যাই আমরাও।
ওদের দিকে চেয়ে বললেন দাদু।  [সমাপ্ত]

* অ্যালান ফিনচ ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের ব্রাইটনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক ছোটগল্প-উপন্যাস লিখেছেন। ‘খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান’ নামের কিশোর উপন্যাসটি তার ‘ট্রেজার ইন দ্য কেভ’ নামক ছোট উপন্যাসের রূপান্তরিত রূপ।

Sunday, December 23, 2018

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান। পর্ব - ৫

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান। পর্ব - ৫


ওদের কান্ড দেখে হেসে ফেলে ওরা দু’জন। কুর্ট ন্যান্সিকে বলে-
: দেখলি তো, ভালো কাজই হলো। এখন সামনে এগোই চল।
আরো একটু পথ এগোয় ওরা। এবার সমস্যা। আগুনের আলোয় দেখল, সামনে দু’দিকে চলে গেছে দু’টি পথ। ন্যান্সি বলে ওঠে-
: ভারি ঝামেলা তো! কোন দিকে যাব এখন?
কুর্ট বলে-
: তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমি চট করে পথ দুটো দেখে আসি। দেরি করব না।
: সাবধানে যাস। ভাইকে সতর্ক করে দেয় ন্যান্সি।
কুর্ট এগিয়ে যায়। সামনে পড়ে একটা বড় পাথর। সাবধানে পাথরের ওপর ওঠে সে। দেখে, ওপাশে সেই বড় গুহাটায় এক সাথে বসে আছে লোকগুলো। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কুর্ট দেখল, নেতা চেহারার সে লোকটি এখন নির্দেশনা দিচ্ছে। সবাই তার কথা মনোযোগের সাথে শুনছে। তার মানে এ লোকটিই এ খারাপ লোকগুলোর নেতা। তাদের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে সে। এখন কাজের দায়িত্ব ভাগ চলছে। লোকটা বলছে, রবার্ট আর সিম্পসন কোকেনের চালান নিয়ে যাবে ডাবলিনে। ক্রিস্টোফার আর স্যামসন হেরোইনের একটি চালান নিয়ে যাবে বেলফাস্টে। হ্যানসেন আর উইলিয়াম হেরোইনের আরেকটি চালান নিয়ে যাবে প্যারিসে এবং ডেভিড আর রন কোকেনের আরেকটি চালান নিয়ে ব্রাসেলসে যাবে। খুব সাবধান। সবগুলো প্যাকেটই আগের মত গোপন ব্যবস্থায় যাবে। তোমরা সবাই নির্দিষ্ট ঠিকানাগুলোতে গিয়ে নগদ টাকা নিয়ে দ্রুত ফিরে আসবে।
এতক্ষণে কুর্ট নিশ্চিত হয় যে এরা এক বিরাট মাদক চক্রের লোকজন। সে অনুমান করে যে সাগরপথে মাদকের চালান এনে এ গুহায় রাখা হয়।
কুর্টের অনুমান অনেকটাই ঠিক। এ সাগর সৈকতটায় লোকজন কম আসে। আর এখানকার গুহাগুলোও মানুষের কাছে আকর্ষণীয় নয়। বিশেষ করে কিছু গুহা পানিতে ভেজা থাকায় পিচ্ছিল হয়ে থাকে। পা পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এগুলোতে কেউ আসে না। কিন্তু একটু উঁচুতে যে কিছু গুহা সব সময়ই শুষ্ক থাকে তা হয়ত কেউ খেয়াল করেনি। তার জানা নেই যে টিলার ওপাশের সদর রাস্তা থেকে একটি শাখা পথ ঘুরে এ গুহাগুলোতে যাতায়াত করা যায়। এই মাদক চক্র যেভাবেই হোক, গুহাগুলোর সন্ধান পেয়েছে এবং তাদের ব্যবহারের উপযোগী করে নিয়েছে। এটা তাদের মাদকের গুদাম। সাগরপথে নৌকায় করে গভীর রাতে তারা এগুলো এনে এখানে জমা করে। তারপর প্রয়োজন মত গাড়িতে করে নানা জায়গায় পাঠায়।
কুর্ট বুঝতে পারে, সকালে তারা হঠাৎ করে এখানে এসে পড়ায় বিপত্তি বেধেছে। তারই শিকার হয়েছে বেচারি লিন। তবে মনে হচ্ছে, এ লোকগুলো মাদক পাচারের সাথে জড়িত হলেও পাকা অপরাধী হয়ত নয়। কারণ, অপরাধীদের কাছে বহু অস্ত্র থাকে- বন্দুক, পিস্তল-রিভলবার, ছুরি, বোমা ইত্যাদি। কিন্তু এদের কাছে সে সব কিছুই নেই। এদিকে লিনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাকে কোথায় রেখেছে কে জানে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না কুর্ট।
হঠাৎ নেতা লোকটি উঠে দাঁড়ায়। সবার উদ্দেশ্যে কথা বলে সে-
: মেয়েটিকে কোণের ছোট ঘরটায় রেখেছ তো? সে খুবই ছোট। তাই তার দ্বারা কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। তবু খেয়াল রেখ তার দিকে। সকালে তাকে ছেড়ে দেয়া যাবে।
তার কথা শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে কুর্ট। যাক, লিন কোথায় আছে তা জানা গেল। এখন তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে।
এ সময় আবার কথা বলে নেতা। তার গলা বেশ গম্ভীর, ভয় ধরানো। বলে-
: এখন আমি যা বলছি সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনো। এখানে আমরা আছি বারো জন। সবাই পোড়খাওয়া, সাহসী মানুষ। এখানে যে হেরোইন ও কোকেন আছে তার দাম এক কোটি ডলার। আমরা যদি সব ঠিকানায় চালানগুলো ঠিকমত পৌঁছে দিতে পারি তাহলে দ্বিগুণ অর্থ পাব অর্থাৎ শুধু লাভের পরিমাণই হবে পঞ্চাশ লাখ ডলার। তার মধ্যে বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় আট-দশ লাখ ডলার দিতে হবে। বাকি ডলার আমাদের মধ্যে ভাগ হবে। এ দিয়ে কিছুদিন সবারই ভালোভাবে কাটবে। এদিকে নতুন চালান আনার চেষ্টা চলতে থাকবে। কারণ সব দেশেই মাদকের চাহিদা ভীষণভাবে বাড়ছে। সুতরাং সবাই যে যার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করবে। কোনো ভুল যে করবে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
একটু থামে নেতা। তারপর আবার কথা শুরু করে, আজ আমাদের বিরাট কাজ রয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে, আটক মেয়েটিকে উদ্ধার করার একটা চেষ্টা করা হতে পারে। তাই অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের দু’জন লোক সারাক্ষণ গুহার প্রবেশ পথে পাহারা দেবে। আমার জানা মতে, পুলিশ এ গুহার কথা জানে না। কিন্তু তাদের অসাধ্য কিছু নেই। তাই যে কোনো জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য আরো দু’জন সাহসী লোক থাকবে এখানে। বাকি সবাই এখন যাব যেখানে গুপ্তধন আছে বলে মনে করা হয় সে গুহাটাতে। শেষ অংশটুকু খুঁড়ে দেখব আসলেই ঐ গুহায় গুপ্তধন লুকোনো আছে কিনা। যদি কোনো সমস্যা বা বিপদ দেখা দেয় তাহলে এরা দ্রুত আমাদের খবর দেবে। কেউ অসতর্ক থাকবে না। বিপদ ঘটলে সবাই মিলে গোপন পথ দিয়ে বেরিয়ে যাব। কেউ আমাদের সন্ধান পাবে না।
অনেক খবরই জানা গেল- ভাবল কুর্ট। কোনো শব্দ না করে সে পাথর থেকে নেমে আসে। চাপা গলায় সব কিছু জানায় দু’জনকে। বলে, লিনকে এ গুহার একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে।
: চলো, এখুনি লিনকে উদ্ধার করে আনি আমরা। বলে ডেভ।
ওর পিঠে হাত রাখে ন্যান্সি। বলে-
: না রে ভাই, বিষয়টা এত সহজ নয়। বুদ্ধি করে কাজ করতে হবে আমাদের।
কুর্টের প্যান্টের এখানে সেখানে কম করে হলেও গোটা পাঁচ-ছয় পকেট রয়েছে। তেমনি ওর গায়ের জ্যাকেটেও আছে আরো গোটা কয়েক। এসব পকেটে যে কি আছে আর কি নেই তা বলা মুশকিল। দাদুবাড়ি আসার আগে সে পকেটে নিয়ে এসেছে ছোট লাইটার, সাদা চক, অনেক মোটা কয়েক গজ সুতা যা চিকন দড়ির কাজ করে, কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি নানা জিনিসপত্র। সে সাথে ওর প্রিয় সুইস নাইফ তো আছেই। বহু কাজের কাজী এ জিনিসটা। চকের টুকরো বের করে আনে সে এ পকেট ও পকেট খুঁজে। সেটা দিয়ে কালো মেঝের ওপর এ গুহার যেটুকু দেখেছে তার ভিত্তিতে একটা ম্যাপ আঁকে কুর্ট। তাতে মাদক চক্রের লোকজন কোথায় বসেছিল ও লিনকে কোনদিকে রাখা হতে পারে, তা দেখানোর চেষ্টা করে সে। গুহাটা বেশ বড়। তার কয়েক জায়গায় আবার ছোট গুহার মত আছে। সেগুলো ঢুকে গেছে ভেতরের দিকে। তৈরি হয়েছে ছোট ছোট ঘর। সেগুলো মাদক চক্রের লোকজন ব্যবহার করে। তারই একটাতে লিনকে রাখা হয়েছে। ওরা যাতে ভালো করে দেখতে পায় সে জন্য হাতের আড়াল করে টর্চ জ্বালে কুর্ট। এতে ন্যান্সি ও ডেভ গুহার ভেতরের পথ ও বড় গুহা সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে যায়।

বড় পাথরটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো তারা। তিনজন টেনে নিয়ে চলেছে ড্রাগনটা। লোকগুলোর কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। কুর্ট ভাবতে থাকে। বড় দলটি যদি গুপ্তধনের সন্ধানে গুহা খুঁড়তে গিয়ে থাকে তাহলেও তো দু’জন পাহারাদার আর সাহায্যকারী মিলিয়ে চারজন লোক থাকার কথা। অতএব হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
পায়ে পায়ে এগোতে থাকে কুর্টের খুদে বাহিনী। দেখতে পায়, একটি ছোট ঘরের সামনে বসে আছে মাদক চক্রের দুই সদস্য। নেশা করেছে বোধ হয়। চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। তাই যথেষ্ট সতর্কতা তাদের মধ্যে নেই। ভালোই হলো, ভাবল কুর্ট। তার চোখে পড়ে, দু’জনের কোলের ওপর দু’টি পিস্তল। ন্যান্সিকে ইশারা করে সে। ডেভকে ড্রাগনের সাথে রেখে তাদের দিকে এগিয়ে যায় দু’জন। চোখের পলকে তুলে নেয় পিস্তল দুটো। তারা টের পেল বলে মনে হলো না। তাদের পেছনে ঘরের মধ্যে ছোটখাটো দেহের কেউ ঘুমিয়ে আছে। সে যে লিন তা বুঝতে দেরি হয় না কুর্টের। এদিকে দু’জন যখন এখানে তাহলে বাকি দু’জন পাহারা দিচ্ছে। এ গুহা থেকে বেরনো বা ঢোকার আরো পথ আছে যা তারা চেনে না। কিছু করার নেই। দু’জন লিনের কাছে পৌঁছে। ন্যান্সি তার শরীর ধরে আস্তে ঝাঁকুনি দেয়। নাম ধরে ডাকে। একবার, দু’বার, তিনবার।
চোখ খোলে লিন। প্রথমে ন্যান্সি, তারপর কুর্টের দিকে তাকায়। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। তারপর ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে। জড়িয়ে ধরে ন্যান্সিকে। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটতে বলে-
: তোরা! কি করে এলি? ওরা টের পায়নি?
ন্যান্সি বলে-
: সে সব কথা পরে হবে। চল, জরুরি কাজ আছে আমাদের।
এ সময় দু’জন লোকের কথার আওয়াজ পাওয়া যায়। মনে হয়, গল্প বলতে বলতে এদিকেই আসছে। দ্রুত ছুটে এসে ড্রাগনের কাছে দাঁড়ায় সবাই। ন্যান্সি ও লিনকে ভেতরে ঢুকতে বলে কুর্ট। নিজে বাইরে ড্রাগনের আড়ালে দাঁড়ায়। এ সময় দু’জন লোক ভেতরে চলে আসে। কুর্ট বুঝতে পারে, তারাই বাইরে পাহারায় ছিল। লোক দু’টি এগিয়ে এসে হঠাৎ করে সামনে এক বিকট ড্রাগন মূর্তি দেখে থমকে দাঁড়ায়। পরক্ষণেই ভীষণ ভয় পেয়ে ওরে বাবারে! বলে চিৎকার দিয়ে ছুটে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। এদিকে এই গোলমালে ঢুলুঢুলু ভাব কেটে গেছে বাকি দু’জনের। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় তারা। নিজেদের পিস্তল খোঁজে। না পেয়ে পরস্পরের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। এ সময় তাদেরও চোখে পড়ে ড্রাগনটিকে। দু’টি চোখ থেকে আগুনের লকলকে শিখা জ্বলছে। হাত দু’টি দু’দিকে ছড়িয়ে রাখা। ড্রাগনটা এখন এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। একবার ড্রাগনের দিকে তাকিয়েই সাহস হারিয়ে ফেলে তারা। দৌড় দেয়।
সাথে সাথে তৎপর হয়ে ওঠে কুর্ট। মুহূর্তের মধ্যে সে বুঝে ফেলে যে তারা বাকি সাথীদের কাছেই যাচ্ছে যারা কিনা গুপ্তধনের খোঁজে গেছে।
: ওদের পেছনে চল সবাই।
বাহিনীর উদ্দেশ্যে নির্দেশ ছুড়ে দেয় কুর্ট। দৌড়াতে শুরু করে নিজে। মাদক চক্রের সদস্যদের হারিয়ে ফেলা যাবে না। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, ন্যান্সি ওর পাশে চলে এসেছে। লিন আর ডেভ এক হাতের মত পেছনে। দৌড়াতে দৌড়াতেই ন্যান্সিকে বলে, পিস্তল ভালো করে ধরিস। গুলি করতে হতে পারে। পারবি তো?
ন্যান্সি দৌড়ের ওপরই জবাব দেয়-
: পারব মনে হয়।
আসলে ন্যান্সি পিস্তল চালায়নি কখনো। কুর্টের একটা খেলনা পিস্তল আছে যেটা আসলের মতই। প্লাস্টিকের নকল গুলি ছোড়া যায়। অনেকবার সেটা নিয়ে খেলেছে সে। আর টিভিতে বিভিন্ন ছবিতে পিস্তলের ব্যবহার দেখেছে। সে সবের ওপর ভরসা করেই জবাবটা দিয়েছে। আসল পিস্তল খেলনা পিস্তলের মত হালকা নয়, বেশ ভারি। যদি গুলি করতেই হয়, হাত শক্ত করে তা করতে হবে।
: ঠিক আছে। লিন আর ডেভের দিকে খেয়াল রাখিস। একটা লড়াই হতে পারে।
মাদক চক্রের দু’জন ওদের চেয়ে জোরে দৌড়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। এদিকে অন্ধকার। তাই কাউকেই চোখে পড়ছিল না। কুর্ট আর ন্যান্সির এক হাতে পিস্তল ধরা, আরেক হাতে টর্চ। তারা এক সাথে টর্চ জ্বালতেই আলোর ফলা বর্শার মত লোক দু’জনকে স্পর্শ করে। সে মুহূর্তে একজন হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়ে। তার কাছে পৌঁছে চারজন একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। লিন রাগ সামলাতে না পেরে কয়েকটি ঘুষি লাগিয়ে দেয় লোকটির মুখে ও মাথায়। লোকটি ওদের কাছে বারবার মাফ চাইতে থাকে। অন্য লোকটি দৌড় থামায়নি। তার সাড়া পাওয়া যায় না। বোধ হয় এ ফাঁকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। সে ভয় পেয়ে গুহার বাইরে পালালো না দলের লোকদের কাছ গেল বুঝতে পারল না ওরা। যাক, একজনকে তো পাওয়া গেছে। একে ভয় দেখিয়ে গুপ্তধনের গুহায় পৌঁছে যেতে পারবে। মাদক চক্রের সদস্যরা সংখ্যায় ওদের চেয়ে দ্বিগুণ, সবাই বড় ও শক্তিশালী। কিন্তু ওদের কাছেও দু’টি পিস্তল আছে আর আছে একজন বন্দী। সুতরাং তারা একেবারে দুর্বল নয়। তবে সবার আগে এ লোকটির ব্যবস্থা করতে হবে, ভাবে কুর্ট। বিশেষ করে এ যেন পালাতে না পারে।
প্যান্টের ঊরুর সাথে লাগানো এক্সট্রা পকেট হাতড়াতে থাকে কুর্ট। পেয়েও যায়। এক পকেট থেকে বের হয় হাত দশেক দীর্ঘ চিকন দড়ির মত মোটা সুতা। লোকটির দু’হাত পেছন দিকে নিয়ে আচ্ছামত বেঁধে ফেলে সে। তারপর তাকে দাঁড় করিয়ে বলে-
: তোমার সাথীরা যে গুহায় গুপ্তধন খুঁজতে গেছে সেখানে নিয়ে চল আমাদের। কোনো চালাকি করবে না। তোমাদের পিস্তল দু’টি আমাদের কাছে। ঝামেলা করলেই কিন্তু গুলি করব। আর হ্যাঁ, তোমার মুখও বেঁধে ফেলা হবে যাতে চিৎকার করে দলের লোকদের সাবধান করতে না পার।
কুর্ট আরেক পকেট থেকে বের করে আনে দু’হাতের মত লম্বা কাপড়।
বন্দীর মুখ বাঁধা হয়ে গেলে এগোতে শুরু করে দলটি। কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ থেমে যায় ন্যান্সি। লিন ও ডেভকে বলে-
: তোরা লোকটার ওপর কড়া নজর রাখ। আমি আর কুর্ট একটা আলোচনা করব।
কুর্টের হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে যায় ন্যান্সি। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে-
: আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?
: কেন, ঐ গুপ্তধনের গুহায়! তাদেরকে আটক করব আমরা। তারা অপরাধী। মাদক সরবরাহ করে বহু মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের ছাড়ব না আমরা, পুলিশের হাতে তুলে দেবো। তাদের ভয়ঙ্কর শাস্তি হওয়া দরকার।
ন্যান্সি বলে-
: না, তাদের আটক করতে যাওয়া মনে হয় আমাদের ঠিক হবে না। ভেবে দেখ, ওরা আটজন আছে ওখানে। আমরা মাত্র চারজন, সবাই ছোট। তারা করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। শুধু দু’টি পিস্তল নিয়ে তাদের সাথে পারব না আমরা। তা ছাড়া আমরা পিস্তল কোনো মত চালাতে পারব, কিন্তু ঐ লোকগুলো নিশ্চয়ই অনেক ভালো পারে। তাদের কাছে আরো মারাত্মক অস্ত্রও থাকতে পারে। তারা আমাদের ধরে ফেললে মেরে ফেলবে।
: তাই তো, আমি ব্যাপারটা এভাবে ভাবিনি। কী করা যায়!
কুর্ট ভাবতে থাকে। মিনিট পাঁচেক কেটে যায়। তখনো ভাবছে কুর্ট। অধৈর্য হয়ে ওঠে ন্যান্সি। বলে-
: কী হলো! কিছু একটা করতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এতক্ষণে যেন কোনো পথ খুঁজে পেয়েছে কুর্ট। বলে-
: শোন ….।
এতক্ষণ ধরে যা ভেবেছে তা ন্যান্সিকে জানায় কুর্ট। না, মাদক চক্রের লোকগুলোর দিকে যাবে না ওরা। কারণ তাদের সাথে পারবে না। তার চেয়ে ওরা এখান থেকে ফিরে যাবে ড্রাগনটাকে যেখানে রেখে এসেছে। এতক্ষণে হয়ত ড্রাগনের আলো নিভে গেছে। সেখানে গিয়ে বড় পাথরের আড়াল থাকবে সে আর লিন। লোকটাকে হাত বাঁধা অবস্থায় ওদের কাছেই রাখবে পিস্তল থেকে গুলির ভয় দেখিয়ে। এদিকে ন্যান্সি আর ডেভ দৌড়ে যাবে বাড়িতে। দাদু আর দাদি জেগে থাকলে ভালো, নইলে তাদের জাগিয়ে তুলবে। জরুরি খবর দিতে বলবে স্থানীয় পুলিশকে। আসতে বলবে দাদুবাড়িতে। পুলিশ এলে ন্যান্সি তখন পুরো ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে বলবে। পুলিশ নিশ্চয়ই রাস্তা দিয়ে গুহায় যাবার পথ চেনে। তারা সেদিক দিয়ে গিয়ে রাস্তা ঘিরে যেন মাদক চক্রের সদস্যদের পালানো রোধ করে। অন্যদিকে ন্যান্সি পুলিশকে বলে তাদের কয়েকজনকে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকের টিলা পেরিয়ে সৈকতের দিক দিয়ে গুহায় ঢুকবে। আর পুলিশকে তার কথা বিশ্বাস করাতে প্রমাণ হিসেবে পিস্তলটা দেখিয়ে বলবে যে মাদক চক্রের লোকদের কাছ থেকে তা পাওয়া। কুর্ট ওদের অপেক্ষায় থাকবে। মাদক চক্রের সদস্যরা যদি গুপ্তধন নিয়ে বড় গুহাটায় ফিরে আসে, কুর্ট আর লিন ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। পুলিশ যদি ঠিকমত পৌঁছায় তাহলে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার, অপরাধীরা গ্রেফতার এবং সে সাথে পুরনো দিনের গুপ্তধনও হয়ত উদ্ধার হতে পারে।
মাথা নাড়ে ন্যান্সি। সময় এখন বড় মূল্যবান। তাই আর দেরি করা ঠিক হবে না। পিস্তল ও টর্চ হাতে ডেভকে নিয়ে রওনা হয় সে। কুর্টকে বলে যায়- যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসবে।
ন্যান্সি ঠিকমত বাড়ি যেতে পারবে কিনা, পুলিশ সাথে নিয়ে কখন ফিরবে, এখন কী করা যায় ইত্যাদি চিন্তায় ডুবেছিল কুর্ট। হঠাৎ লিনের চিৎকারে চমকে ওঠে সে। দেখে, মাদক চক্রের যে লোকটিকে হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল সে উঠে দৌড় দিয়েছে। চোখের পলকে তার পিছু ধাওয়া করে সে। লোকটি পেছনে হাত বাঁধা থাকায় মোটেই জোরে দৌড়াতে পারছিল না। তাই দ্রুতই তার নাগাল পেয়ে যায়।
: এই থাম, নইলে গুলি করব বলছি- হুমকি দেয় কুর্ট।
কিন্তু থামে না লোকটা। বোঝা গেল, সদ্য কিশোর কুর্টকে পাত্তাই দিচ্ছে না। গুলি করবে তাকে? না, সেটা ঠিক হবে না। তাতে লোকটি আহত হবে, ঝামেলা বাড়বে। তা ছাড়া তার দলের লোকেরা গুলির আওয়াজ শুনে ছুটে আসতে পারে। তখন বিপদ বাড়বে। আর কোনো উপায় না দেখে পেছন থেকে তাকে এক ধাক্কা দেয় কুর্ট। সাথে সাথে লোকটি হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে। পিস্তলটা বের করে লোকটির ঘাড়ের পেছনে চেপে ধরে। কঠিন গলায় বলে-
: উঠে দাঁড়াও। সাবধান। কোনো গোলমাল করার চেষ্টা করলেই গুলি করব।
ইতোমধ্যে লিন এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা কাঠের টুকরো। সেটা দিয়ে লোকটার পিঠে গোটা কতক ঘা লাগিয়ে দেয় সে। লিনকে থামায় কুর্ট। তারপর দু’জনে টেনে তোলে লোকটাকে। হাতের বাঁধনটা পরীক্ষা করে। না, ঠিকই আছে। পাথরের আড়ালে এসে গুহাতে বসে পড়ে তারা। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই।
[চলবে]
খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান। পর্ব- ৪

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান। পর্ব- ৪


৪.

পড়ে গিয়ে একটু সময় চুপ করে শুয়ে থাকে ডেভ। তারপর পড়ে যাওয়া কাঠের টুকরোটা তুলে নিয়ে গুহামুখের দিকে হাঁটতে শুরু করে। সেখানে ন্যান্সি আছে। ডেভের যাওয়ার পর খানিকটা অপেক্ষা করে কুর্ট। এতক্ষণে ন্যান্সির কাছে সে পৌঁছে গেছে বলে অনুমান করে সে। বাকি ক’ টুকরো কাঠ, সবটা দড়ি আর ক্যানভাসের টুকরোগুলো এক সাথে করে কাঁধে তুলে নেয় কুর্ট। লিনকে ঐ লোকগুলোর কাছে একা রেখে বেরিয়ে আসে। তার খারাপ লাগছিল খুব। ফিসফিস করে নিজেকে শোনায়- লিনকে উদ্ধার করতে দ্রুত ফিরে আসব।

গুহার বাইরের উজ্জ্বল সূর্যালোকে দাঁড়িয়েছিল ওরা দু’জন। কুর্টকে দেখে জিজ্ঞেস করে ন্যান্সি-
: লিনকে মুক্ত করার কথা কী ভাবছিস?
: আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। ড্রাগন বানাতে হবে।
: কি বলছিস, ড্রাগন দিয়ে কি হবে? আর তা বানাবই বা কিভাবে? প্রশ্ন করে বিস্মিত ন্যান্সি।
কুর্ট বলে-
: এখন কথা বলার সময় নেই। চল, কাজ শুরু করি।
সব কাঠ, ক্যানভাসের টুকরো আর দড়ি মিলিয়ে একটা ড্রাগন বানানোর কাজ শুরু করে ওরা।

খানিকটা সময় পর ড্রাগনের কাছাকাছি দেখতে কিছু একটা তৈরি হয়ে যায়। একটু দূরে গিয়ে তৈরি করা জিনিসটিকে পরখ করে দেখে ওরা।
: চলনসই একটা ড্রাগন, কি বলিস তোরা?
ন্যান্সি আর ডেভ সায় দেয় তার কথায়।

হাতের ঘড়িতে সময় দেখে কুর্ট। প্রায় দশটা। বলে-
: চল, এখন আমরা বাড়ি ফিরে যাই। সারাদিন আর এখানে আসা হবে না। সন্ধ্যা হলে লিনকে উদ্ধার করতে আমাদের অভিযান শুরু হবে।

তার কথায় চমকে ওঠে ন্যান্সি-
: কী বলছিস তুই? লিনকে ঐ খারাপ লোকগুলোর হাতে ফেলে আমরা চলে যাব? আর রাতে আমরা ওকে উদ্ধারই করব কিভাবে? এখুনি পুলিশের কাছে চল।

: থাম। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ ব্যাপারটা। আমরা যদি লিনের আটক হওয়ার কথা দাদুকে জানাই সাথে সাথে পুলিশকে জানাবেন তিনি। বাবা-মাও জেনে যাবেন সব। আমাদের এখানে আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। আর পুলিশকে খবর দিয়ে আনতে আনতে কমপক্ষে এক ঘন্টা লেগে যাবে। তাদের মনে যদি খারাপ ইচ্ছা থাকে তাহলে লিনকে এর মধ্যে অন্য কোথায়ও সরিয়ে ফেলতে পারে, সে সাথে সবাই পালিয়েও যেতে পারে। তখন ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে। আর এখন যদি লিনের খোঁজে কেউ না যায় তাহলে ব্যাপারটাকে তারা গুরুত্বই দেবে না। তা ছাড়া ক্ষতিকর কেউ নয় ভেবে ওকে ছেড়েও দিতে পারে। 

বড়জোর আটকে রাখবে। আমার মনে হয়েছে, এটা ওদের নিরাপদ আস্তানা। এখানেই থাকবে তারা। সন্ধ্যায় আমরা আসব।

কুর্টের যুক্তি একেবারে ফেলে দেয়ার মত নয়, ভাবে ন্যান্সি। কিন্তু লিন এখানে থাকবে ভাবতেই ভয় হচ্ছে তার। রাতে এসে যদি লিনকে উদ্ধার করতে না পারে তখন কী হবে?

কুর্টকে কথাটা বলার পর ও বলে-
: তখন বাধ্য হয়ে পুলিশকে জানাতেই হবে।
: কিন্তু দাদু আর দাদি লিনকে না দেখে তো জানতে চাইবেন তার কথা। তখন? ডেভ জিজ্ঞেস করে।
এর জবাব দেয় ন্যান্সি-
: বলব যে মাথায় ব্যথা হয়েছে বলে লিন ঘরে ঘুমাচ্ছে। এখন বড় কথা যে এ ড্রাগনটিকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে।

কুর্ট আশপাশ ঘুরে দেখতে যায়। মিনিট দশেক পর ফিরে আসে সে। খুশিভরা গলায় বলে, পেয়েছি।
গজ পঞ্চাশেক দূরে দু’টিলার মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে এসেছে। তার মধ্যে তাদের কাঠ-কাপড়ের এ প্রাণহীন ড্রাগনটাকে লুকিয়ে রাখা যাবে। এদিকে লোকজন আসে না। অতএব ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত এটা ঠিক থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়।

ওরা বাড়ি ফেরার পর কোনো সমস্যা হলো না। লিন যে নেই, তা দাদু আর দাদি খেয়ালই করলেন না। লাঞ্চের পর ওরা জড়ো হল কুর্টের ঘরে। শুরু হল আলোচনা। কে জানে লিন এখন কেমন আছে। ঐ লোকগুলো তাকে কিছু খেতে দিয়েছে কি না। তবে বড় কথা হচ্ছে, ওরা তাকে উদ্ধার করবে কিভাবে, আর কখন রওনা হবে। কুর্ট ততক্ষণে একটা পরিকল্পনা ছকে ফেলেছে।

: রাত ঠিক সাড়ে আটটায় রওনা হব আমরা। সবার কাছে একটা করে টর্চ থাকবে যাতে অন্ধকারে কোনো অসুবিধা না হয়।

ঠিক সময়ে কোনো শব্দ না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে তারা। ওরা জানে, দাদু বা দাদি কেউই ওদের খোঁজ করবেন না। একবার বেডরুমে ঢুকলে সকালের আগে আর ঘর থেকে বের হন না তারা। বাইরে বেরিয়ে দেখল, আকাশে চাঁদ উঠেছে। বেশ আলো ছড়াচ্ছে। তাই টর্চ জ্বালানোর দরকার হলো না। সৈকতে পৌঁছে যায় ওরা।
জিজ্ঞেস করে ন্যান্সি-
: আচ্ছা, তোর প্ল্যানটা কী? একটু বল আমাদের।
: আমরা এখন ড্রাগনটা নিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকব। আমার ধারণা যে রাতের বেলা গুহার মধ্যে ড্রাগনের মত কিছু দেখে ওরা ভয় পাবে এবং পালাবে। তখন লিনকে নিয়ে আমরা বেরিয়ে আসব। তবে এ লোকগুলোর ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। ওরা যেন আমাদের ধরতে না পারে।

কাঠ, ক্যানভাস ও দড়ি দিয়ে ড্রাগনের মত যে জিনিসটা কুর্ট বানিয়েছিল তা প্রায় ছয় ফুট লম্বা। কাঠের কাঠামোর ওপর এটা তৈরি। পুরো কাঠামো ক্যানভাসে ঢাকা। মুখটা কদাকার, দু’দিকে কাঠের টুকরো দিয়ে হাত তৈরি করা হয়েছে। ফ্রেমের ভেতরটা এমন করে বানানো যে প্রয়োজনে দু’জন সেখানে বসতে পারবে। সেটাকে ধরে বাইরে নিয়ে আসে তারা। কুর্ট বলে-
: ডেভ, তুই এর ভেতরে বসবি। আর আমরা দু’জন এটাকে টেনে নিয়ে যাব গুহার মধ্যে। এটা দিয়ে ভয় দেখিয়েই ওদের কাছ থেকে লিনকে উদ্ধার করব আমরা।
ডেভ ড্রাগনের ভেতরে গিয়ে বসে। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছে সে।

গুহার ভেতরে ঢোকে ওরা। আস্তে আস্তে হাঁটছে, চোখ খাপ খাইয়ে নিচ্ছে অন্ধকারে। কিছুটা এগিয়ে থেমে যায়। সামনে আগুন জ্বলছে । বেশ কিছু লম্বা কাঠ দিয়ে জ্বালানি  হয়েছে আগুন। মনে হয়, কয়েকটি কাঠের তক্তা মাঝখানে ফেড়ে নেয়া হয়েছে। আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয়, ঠান্ডা তাড়াতেই এ আগুনের ব্যবস্থা। কুর্টের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। জ¦লন্ত কাঠগুলো থেকে দু’টি তিন-চার হাতের মত লম্বা টুকরো তুলে আনে। সেগুলোর আগুন না জ¦লা দিকটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে ড্রাগনের উপরের দিকের দু’পাশে। এতে ড্রাগনের চেহারাটা আরো ভীতিকর হয়ে ওঠে। হঠাৎ এটাকে দেখলে যে কেউই ভাববে যে ড্রাগনের দু’চোখ থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে। তাতে তারা ভয় পেতে পারে।
ড্রাগন নিয়ে খানিকটা এগিয়ে যেতেই দু’ জন লোককে দেখতে পায় ওরা। দু’টি মাঝারি আকারের পাথরের ওপর বসে আছে। মাঝে মাঝে গুহার পথের দিকে চেয়ে দেখছে। পাহারায় রয়েছে হয়ত। কুর্টের মনে হলো, লোক দু’টি তেমন সতর্ক নয়, কেমন যেন ঢিলেঢালা ভাব তাদের মধ্যে। কে জানে, নেশা করেছে হয়ত। হঠাৎ সামনে ড্রাগন দেখে ভড়কে যায় তারা। ভয়ঙ্কর দানবটা অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। আগুনের শিখায় বোধ হয় পুড়িয়ে মারবে ওদের। প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় তারা। দৌড় দেয় কোনো কথা না বলে। মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
[চলবে]
খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান - পর্ব- ৩

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান - পর্ব- ৩


৩.
লাঞ্চের আগেই চলে গিয়েছিলেন জিম দাদু। লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়ে ওরা।
সৈকতের পুব দিকে বেশ কয়েকটি গুহা। সেগুলোর কোনো কোনোটিতে জোয়ারের সময় পানি ঢোকে। আবার কয়েকটি বেশ উঁচুতে বলে জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে পারে না। সব মিলিয়ে দশ-বারোটা গুহা। কুর্ট তার বাহিনীর দিকে তাকিয়ে দেখল। এর আগে তাদের কারোরই গুহায় ঢোকার অভিজ্ঞতা হয়নি। ওর ইচ্ছে, সবাইকে নিয়ে প্রতিটি গুহা ঘুরে দেখবে। বিশেষ করে এ গুহাগুলো পুরনো হওয়ায় হয়ত এমন কিছু ওরা পেয়ে যেতে পারে যা মূল্যবান।

প্রথম গুহাটার ভেতরটা ভেজা, মেঝে পিছল। বোঝা গেল, জোয়ারের সময় এখানে পানি আসে। সেটা থেকে বেরিয়ে এল ওরা। দ্বিতীয়টিতে ঢুকল। একই অবস্থা। বেরিয়ে এসে ঢুকল আরেকটিতে। এটি খানিকটা উঁচুতে। মেঝে শুকনো, আকারে বেশ বড়। ওরা ঘুরে দেখতে লাগল। গুহার শেষ দিকটা অন্ধকারে গিয়ে মিশেছে। কুর্টের মনে হলো, এদিকটা এগিয়ে গেছে এমন এক দিকে যেদিক দিয়ে হয়ত বাইরে যাওয়া যায়। তার মানে এ গুহায় কেউ বা কারা সম্ভবত আসা-যাওয়া করে। এ সময় খুব শীত বোধ করতে থাকে সবাই। হঠাৎ করেই তার হাত ধরে টান দেয় ন্যান্সি। আঙুল তুলে দেখায় অন্ধকারের দিকে। কুর্ট তাকায় সেদিকে। তার মনে হয়, কারো ছায়া নড়ছে অন্ধকারে। কিন্তু কোনো শব্দ নেই। এ ছায়া কি মানুষের? নাকি ভূতের? ভয়ের শিহরণ বয়ে যায় কুর্টের শরীরে।
: এগুলো কী? কিছু বুঝতে পারছিস? খুব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে ন্যান্সি।
মাথা নাড়ে কুর্ট-
: না।

এদিকে অন্ধকারে ছায়ার নড়াচড়া দেখে ভয় পেয়ে যায় লিন আর ডেভ। কাঁদতে কাঁদতে ডেভ বলে-
: আমার ভয় করছে। বাড়ি যাব।
তার সাথে সুর তোলে লিনও-
: এখানে থাকব না। আমি চলে যাব।
দু’জনে কাছে টেনে নেয় দু’ ভাই-বোনকে। ন্যান্সি খুব নিচু গলায় তাদের বোঝায়-
: কাঁদছিস কেন তোরা? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা তো চারজন। সবাই তো সাহসী তাই না? তাহলে ভয় পাব কেন? কিন্তু তোরা যদি কাঁদতে থাকিস তাহলে কান্না শুনে দুষ্ট লোকেরা চলে আসবে, আমাদের ধরে ফেলবে।
ওদের কান্না থেমে আসে। ডেভ কুর্টের আর লিন ন্যান্সির হাত শক্ত করে চেপে ধরে।

ওরা যে সাথে করে দু’টি টর্চ নিয়ে এসেছিল তা খেয়ালই ছিল না। ন্যান্সিরই আগে মনে পড়ে। ব্যাকপ্যাক ছিল কুর্টের পিঠে। তাকে বলে-
: টর্চগুলো বের কর ভাইয়া।
: আরে তাই তো! আমার তো মনেই ছিল না।
দ্রুত হাতে ব্যাকপ্যাক থেকে টর্চ দুটো বের করে আনে কুর্ট। একটি নিজে নিয়ে অপরটি ন্যান্সির হাতে ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তেই আলোর দু’টি বর্শাফলক ছিঁড়ে ফেলে অন্ধকারের কালো পর্দা। সে আলোতে আরেকটু ভেতরের দিকে এগোয় ওরা। কয়েক গজ এগোনোর পর গুহার পথটি বেশ চওড়া হয়ে যায়। আরেকটু এগিয়ে বামে বাঁক নিতেই চমকে যায় ওরা। অনেকটা জায়গা নিয়ে বেশ বড় একটি গুহা। দু’টি পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে। ফলে আলোকিত হয়ে আছে জায়গাটা। সেখানে বেশ কয়েকজন কঠিন চেহারার লোক মেঝেতে বিছানো ম্যাটের ওপর বসে। নানা রকমের অনেকগুলো প্যাকেট একদিকে জড়ো করে রাখা। মনে হয়, মাদকদ্রব্য আছে সেগুলোতে।
কুর্টের দল থমকে দাঁড়ায়। কাছেই একটি বিরাট পাথর। তার পেছনে লুকায় তারা। আগেই টর্চ নিভিয়ে দিয়েছিল কুর্ট আর ন্যান্সি। হঠাৎ লক্ষ করে যে তারা পাথরের পেছনে লুকালেও লিন তখনো কি করবে বুঝতে পারেনি। সে দাঁড়িয়ে আছে খোলা জায়গায়। সে মুহূর্তে লিনের পেছনের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে বিরাটদেহী এক ব্যক্তি। তার বিশাল দু’টি হাত তুলে নেয় লিনকে। তারপর তাকে ধরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় মেঝেতে বসে থাকা লোকগুলোর সামনে।
: আরে, এ কে? কোত্থেকে এল এখানে রিড?
নেতা গোছের এক লোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
: তা তো জানি না বস। আমি গুহার পথটায় টহল দিচ্ছিলাম। এবার ফিরতেই একে এখানে দেখতে পেলাম।
কুর্ট আর ন্যান্সি বুঝতে পার এর ছায়াই তারা দেখেছিল।
নেতা লিনের দিকে তাকায়। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করে-
: কে তুমি, কি নাম তোমার? কেন এসেছ এখানে?
লিন লোকটার প্রশ্নে ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলে। ভীষণ বিরক্ত হয় লোকটি। রিডকে নির্দেশ দেয়-
: মেয়েটার দু’হাত ভালো করে বেঁধে কোথাও রাখ। তারপর তুমিও এস এখানে। জরুরি আলোচনা আছে।
এদিকে এ আকস্মিক ঘটনায় বিস্মিত হয়ে পড়ে কুর্ট ও ন্যান্সি। পরস্পরের দিকে তাকায় তারা- ভাবখানা এই যে এ কী হলো? অন্যদিকে ডেভ ভয় পেয়ে ন্যান্সির কানে ফিসফিস করে বলে-
: আপি! এবার কী হবে? ওরা কি লিনকে মেরে ফেলবে?
তাড়াতাড়ি ওকে থামায় ন্যান্সি। সে নিজেও ভয় পেয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও সান্ত¡না দেয় ডেভকে-
: না ভাই, ওর কিছু হবে না। আমরা ওকে উদ্ধার করব এখুনি।
পেট্রোম্যাক্সের আলো জ¦লতে থাকায় এদিকে অন্ধকার তেমন গাঢ় নয়। সবই মোটামুটি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কুর্টের মাথায় লিনকে উদ্ধারের কথা ঘুরছে। চারপাশে তাকায়। দেখে, একদিকে বেশ কিছু আবর্জনা জমে আছে। তার মধ্যে রয়েছে কিছু ক্যানভাস কাপড়, পোড়া কাঠ ও কিছু দড়ি।
কুর্টের মাথার মধ্যে চিন্তা চলছে। ফিসফিস করে দু’জনের উদ্দেশে বলে-
: এখানে যেসব জিনিসপত্র আছে, এগুলো আমাদের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু খুব সাবধানে যাতে এ লোকগুলো কিছু টের না পায়। আমরা একজন একজন করে এগুলো বাইরে নিয়ে যাবো।
কুর্ট প্রথমে ন্যান্সিকে একটি বড় সাইজের পোড়া কাঠের টুকরো দেয়। ও সেটা নিয়ে বাইরে যায়। ন্যান্সির ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কুর্ট। কিন্তু তার দেরি হচ্ছে দেখে ডেভকে কিছু কাঠ দিয়ে পাঠায় বাইরে। বলে-
: তুই ন্যান্সির কাছে যা, কোনো শব্দ করিস না যেন।
ভাই ওকে একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে ডেভের। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দু’ চোখ।
: ঠিক আছে। বেরিয়ে যায় ডেভ।
কিন্তু ভাগ্য খারাপ ডেভের। তার বয়ে নেয়া কাঠগুলো থেকে একটা বড় টুকরো কিভাবে যেন মেঝেতে পড়ে যায়। একটা শব্দ হয়। সাথে সাথে সতর্ক হয়ে ওঠে গুহার লোকগুলো। কথা বন্ধ হয়ে যায়। শব্দের উৎসের সন্ধানে তাকায় তারা। ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে কুর্টের। লোকগুলো যদি শব্দের কারণ খুঁজতে এদিকে আসে তাহলে ধরা পড়ে যাবে সে, সে সাথে ন্যান্সি আর ডেভও। কিন্তু না, কেন জানি লোকগুলো এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিল না।
[চলবে]
খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান - পর্ব -২

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান - পর্ব -২

২.
ওরা চার ভাই-বোন স্কুলের ছুটিতে ক’দিনের জন্য ব্রাইটনে দাদু বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। দাদু-দাদির সাথে ওদের বাবা-মার সম্পর্ক তেমন জোরালো না। তারা দাদু বাড়িতে আসেন না। তার কারণ জানে না ওরা। তবে কুর্ট একটু বড় হওয়ায় ব্যাপারটা অল্পস্বল্প আঁচ করেছে। ওদের মাকে একটুও পছন্দ করেন না বুড়োবুড়ি, বিশেষ করে দাদি। তবে একমাত্র সন্তান হওয়ায় ওদের বাবার সাথে তারা সম্পর্ক একেবারে ছেদ করতে পারেননি। বিশেষ করে দাদুর ছোট ভাই জিম দাদু এটা হতে দেননি। বলতে গেলে তিনিই এ সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছেন। কারণ, ছোটবেলা থেকেই বাবাকে ভীষণ স্নেহ করেন তিনি। তার নিজের ছেলে নেই, দু’ মেয়ে। তাই কুর্টের বাবা চার্লসই তার ছেলে। মাঝে মধ্যেই লন্ডনে ওদের বাড়িতে ছুটির দিনে চলে আসেন জিম দাদু। বাবার সাথে গল্প-গুজব আর হাসি-ঠাট্টায় কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে যান। আর তিনি এলে বাবা যে কী খুশিই হন!
সেই জিম দাদুই দু’ বছর আগে প্রথম ওদের বড় তিনজনকে দাদু বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে আসেন। শহরের এক প্রান্তে সাগর তীর থেকে শ’ দুয়েক গজ দূরে দাঁড়ানো দাদুর পুরনো কালের প্রাসাদের মত একতলা বাড়িটা। পাকাপোক্ত গাঁথুনির বাড়িটা চমৎকার। সারাক্ষণ সাগরের বাতাস এসে জানালা-দরজায় বন্ধুর মত পরশ বুলিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে ঝড় বয়ে যায় এ এলাকায়। তখন সাগর ফুলে ওঠে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় না এ বাড়ির। এমনিতে বাড়িটা সুদৃঢ়, ঝড় তাকে কাবু করতে পারে না। আর সাগরের প্রবল জোয়ারও এখানে পৌঁছতে পারে না। কারণ, সাগর রয়েছে বাড়ির পেছন দিকে। আর সাগর ও বাড়ির মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো টিলা। সাগরের পানি যতই ফুলে উঠুক, টিলা পেরিয়ে এদিকে আসতে পারে না। সাগরে যাবার অন্য পথও আছে। কিন্তু কুর্ট বাহিনীর কাছে এই টিলা পেরিয়ে যাওয়াটাই পছন্দের।

এ নিয়ে তিনবার এল ওরা। গত বছর দ্বিতীয়বার তারা এসেছিল। অবশ্য সবাই নয়। আগের দু’বার ছোট বলে ডেভকে মা ছাড়েনি। ফলে তার আসা হয়ে ওঠেনি। এ বছর সে প্রথম এসেছে দাদু বাড়িতে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে তারা, আর দশটি ছেলে-মেয়ের মত দাদু-দাদির বিপুল স্নেহ ওদের ওপর উপচে পড়ে না। কেমন যেন মাপা কথাবার্তা বলেন তারা। নাতি-নাতনিদের প্রতি অনাদর নেই, কিন্তু মমতা মাখা উচ্ছ্বসিত আদরও নেই। তবে ওরা এসব নিয়ে ভাবে না। প্রথম কথা, ওদের একটা দাদু বাড়ি আছে ও দাদু-দাদি আছে। এটা বিরাট ব্যাপার। দ্বিতীয় কথা, সেখানে একটু দূরেই একটা ছোট কিন্তু সুন্দর, নিরিবিলি সমুদ্র সৈকত আছে। বেশ নিরাপদও। সেখানে ওরা আশ মিটিয়ে হৈ চৈ, খেলাধুলা, ছুটোছুটি করতে পারে। ক’টা দিন কাটাতে পারে খুশি-আনন্দে। তারপর তো আবার ফিরে যাওয়া সেই স্কুল আর লেখাপড়ার একঘেয়ে পরিবেশে।

সকাল সাতটা বাজতেই উঠে পড়ে সবাই। ঝটপট ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোতে হবে। সারাদিনের প্রোগ্রাম। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় টগবগ করছে সবাই। কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ নেই। দাদু-দাদি টের পেয়ে গেলে হয়ত যেতেই দেবেন না। ওরা ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখল টেবিলে ব্রেকফাস্ট রেডি। স্যান্ডউইচ, কেক, কর্নফ্লেক, দুধ। আর আছে আপেল, কমলালেবু, আঙুর। পরিমাণে যথেষ্ট। দাদি বললেন-
: বাচ্চারা বসে পড়। তাড়াহুড়ো করবে না। ধীরে সুস্থে খাবে।

খেতে খেতে দাদু-দাদির চোখ এড়িয়ে চারজনের লাঞ্চের ব্যবস্থা করে ফেলল কুর্ট আর ন্যান্সি। একটা থলে সাথে নিয়ে এসেছে সে। দ্রুতই ভরে ফেলল সেটা। চারজনের লাঞ্চ ভালো মতই হয়ে যাবে। এখন যেভাবেই হোক ন্যান্সির রুম পর্যন্ত তা নিয়ে যেতে হবে। সে সুযোগটাও এসে গেল। দাদি কী কাজে যেন কিচেনে গেলেন। তার পিছু পিছু গেলেন দাদুও। সে ফাঁকে ন্যান্সি চোখের পলকে হালকা খাবারের থলেটা তার রুমে রেখে এল।

এখন পর্যন্ত সব ঠিকই আছে। ব্রেকফাস্ট সেরে সবাই গিয়ে বসল ন্যান্সির রুমে। চটপট বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কথা উঠল, যদি কোনো কারণে তারা লাঞ্চে বাড়িতে না ফেরে তাহলে ঝামেলা হয়ে যাবে। দাদি ভীষণ কড়া মহিলা। নিয়মের এদিক ওদিক করা তার একেবারেই পছন্দ নয়। তাদের সাথে দাদুর আচরণ বরং অনেক নরম। কিন্তু সারাক্ষণ তিনি দাদির সাথেই থাকেন, তার কাছ ছাড়া হন না। তাই নাতি-নাতনিদের সাথে আলাদাভাবে মিশে নৈকট্য গড়ে তোলার সময় হয় না তার। তবে ওরা তার একমাত্র সন্তানের ছেলে মেয়ে, তারই রক্ত। তাই ওদের দিকে খেয়াল ঠিকই আছে তার। আসলে ছেলের বউ প্যাটির সাথে কেন যেন বনিবনা হল না শাশুড়ি এলিজাবেথের। অবস্থাটা এমন যে তার সাথে দেখা বা কথাও বলেন না এলিজাবেথ। আর প্যাটিও তেমনই। শাশুড়িকে আপন করার কোনো চেষ্টাই করেন না। এতে খুব যে একটা সমস্যা হয়েছে তা নয়, কিন্তু নাতি-নাতনিগুলোকে সব সময় বা বেশিরভাগ সময় কাছে না পাওয়ার একটা কষ্ট আছে তাদের। ওরা বেড়াতে এসে খুশি মত ঘুরে বেড়াচ্ছে, খেলছে। তারা কিছু বলেন না। তবে খেয়াল রাখেন যেন কোনো সমস্যার মুখে না পড়ে। তাদের জানা নেই যে ওরা এখন সাগর তীরে পাহাড়ি গুহাগুলোতে যাচ্ছে। বিশেষ করে দাদু যদি জানতেন তাহলে বাচ্চাদেরকে গুহাগুলোর দিকে যেতে দিতেন না। কারণ, আবছাভাবে তার কানে এসেছে যে সম্প্রতি কিছু খারাপ ধরনের লোকজন গুহাগুলোতে যাওয়া-আসা করছে। হয়ত বা পুলিশের চোখ এড়িয়ে সেখানে কোনো অবৈধ কাজ-কারবার করে তারা। সেটা মাদক পাচারও হতে পারে। এ সব কাজে জড়িতরা খুবই বাজে লোক। তারা পারে না এমন কাজ নেই।

আটটা বেজে গেছে। ওরা ঘর থেকে বের হবে, এমন সময় ডোর বেল বেজে উঠল। কে না কে এসেছে, তা দেখা ওদের ব্যাপার নয়। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই দাদু দরজা খুলে দিলেন। তার ঘরের পাশে বলেই হয়ত। বসার ঘরে ঢুকলেন জিম দাদু। পর মুহূর্তেই হাঁক শোনা যায় তার-
: কই কুর্ট, ন্যান্সি তোমরা কোথায়।
থমকে যায় সবাই। কুর্ট বলে-
: সেরেছে। জিম দাদু এসে গেছেন। এ বেলায় আর যাওয়া হলো না তাহলে। ঠিক আছে, লাঞ্চের পরই না হয় বেরিয়ে যাব আমরা। এখন সব কিছু রেখে তার কাছে যাই চল। তিনি ডাকছেন।

জিম দাদু ওদের খুব ভালোবাসেন। ওরাও ভালোবাসে তাকে। সবাই গিয়ে তার কাছে বসতেই আড্ডা জমে ওঠে।(চলবে)

Saturday, December 22, 2018

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান - পর্ব -১

খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান - পর্ব -১



খুদে বাহিনীর গুহা অভিযান মূল : অ্যালান ফিনচ রূপান্তর : হোসেন মাহমুদ। পর্ব -১


পাথুরে টিলার ওপর দিয়ে হাঁটছিল ওরা- ন্যান্সি আর কুর্ট। আরো দু’তিনটা টিলার পর সৈকত। টিলাগুলোর নিচ থেকেই বালিময় সৈকত শুরু হয়েছে। মিশেছে সাগরে। সেখানে খেলছে ওদের ছোট দু’ভাই-বোন- লিন আর ডেভ। কিছুক্ষণ আগে সৈকতে এসেছে ওরা। বড় থেকে ছোট পর্যন্ত ওদের চার ভাই-বোনের প্রত্যেকের মাঝে বয়সের ব্যবধান দু’বছর। সবার বড় কুর্টের বয়স পনেরো। ন্যান্সির তেরো। লিন এগারোতে, আর ডেভের নয় চলছে। লিন আর ডেভ সৈকতে খেলার ছলে বালির প্রাসাদ গড়ছে আর ভাঙছে। আনন্দে আছে ওরা।


ওদেরকে খেলায় মেতে উঠতে দেখে কুর্ট আর ন্যান্সি টিলাগুলো একটু ঘুরে দেখতে গিয়েছিল। বিশেষ করে গুহাগুলোর দিকটা। এর পেছনে একটা কারণ আছে। কাল বিকেলেই তারা মি. ওলসেনের কাছে গল্পটা শুনেছে। মি. ওলসেন দাদু বাড়ির কেয়ারটেকার। শুধু দিনের বেলা থাকেন তিনি। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তার ডিউটি। সত্তরের কাছে বয়স তার। খুব ভালো আর সাদাসিধে মানুষ। মাঝে মাঝে ওদের গল্প শোনান তিনি। তিনিই বলেছেন, সৈকতের পুবদিকে পাথুরে টিলার নিচে গোটাকয় গুহা আেেছ। প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো। গুহাগুলো খুব পুরনো। মানুষ ওদিকে মোটেই যায় না। গুজব আছে যে কবে কোনকালে জলদস্যুরা এসব গুহার কোনো একটিতে লুট করে আনা ধনরত্ন রেখেছিল। কিন্তু পরে সেগুলো তারা এখান থেকে আর নিতে পারেনি। কারণ, তার কিছুদিন পরেই এক যুদ্ধে জলদস্যু নেতাসহ কয়েকজন মারা পড়ে, বাকিরা আটক হয়ে বাকি জীবন জেলে কাটায়। গুজব গুজবই। তা লোকে শোনে, কিন্তু বিশ্বাস করে কম। তাই কেউ সে গুজবের জিনিস খুঁজতে যায়নি বা গেলেও পায়নি। ওরা দু’জন সে গুহাগুলোর লোকেশন দেখতে গিয়েছিল কৌতূহলী হয়ে। দেখেছে। এখন ফিরে যাচ্ছে লিন আর ডেভের কাছে।


দু’জন সৈকতে ওদের কাছে গিয়ে পৌঁছলো। ঠিক সে মুহূর্তেই ডেভ লাফিয়ে পড়ে অনেক সময় নিয়ে গড়ে তোলা লিনের বালির প্রাসাদের ওপর। চোখের পলকে লীন হয়ে গেল সেটা। প্রতিশোধ নিতে লিনও লাফিয়ে পড়ল ডেভের তৈরি করা প্রাসাদের ওপর। ব্যস, শোধবোধ। হাসিতে ভেঙে পড়ে দু’জন।


এ সময় কমান্ডারের ঘোষণা শোনা গেল- বিকেলের চা পানের সময় হয়ে গেছে। চল, এখন বাড়ি ফিরতে হবে। নইলে দাদি ভীষণ রেগে যাবেন। চা খাওয়ার পর আমাদের পরবর্তী প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করব।


সবার বড় হিসেবে চার ভাই-বোনের এ খুদে বাহিনীর কমান্ডার কুর্ট। ন্যান্সি সহকারী কমান্ডার। ছোট দু’জন সৈনিক মাত্র। চার ভাই-বোনের মধ্যে নানা বিষয়ে খুব মিল। প্রায় প্রতি ছুটির দিনেই একটা সময় ঠিক করে নিয়ে পাড়ায় একটা রাউন্ড দেয় তারা। ফলে সবাই তাদের ভালো করেই চেনে। বন্ধুদের কেউ কেউ ওদের নাম দিয়েছে খুদে বাহিনী। ওরা নামটি তেমন পছন্দও করেনি, আবার প্রতিবাদও করেনি। তাই মোটামুটি এ নামটাই চালু হয়ে গেছে ওদের ব্যাপারে। ন্যান্সির কথা, খুদে বাহিনী শুনতে ভালো লাগে না। ওরা তো কোনো কাজ করে না, তাহলে ওদের বাহিনী বলা হবে কেন? তবে ‘গ্রুপ ফোর’ বললে আপত্তি নেই তার। নামটি বেশ আধুনিক। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের মধ্যে। শিগগিরই হয়ত নামটা অনুমোদন করবে সবাই মিলে।


টিলায় উঠল ওরা সবাই। কয়েকটি টিলা পেরিয়ে পৌঁছে গেল বাড়ির সীমানার পেছন দিকের দরজায়। খোলাই ছিল সেটা। ভেতরে পা রাখল ওরা। খানিকটা খোলা জায়গা। তা পেরিয়ে চারধাপ সিঁড়ি টপকে পৌঁছে গেল বাড়ির করিডোরে।


প্রথমেই ওরা গেল কিচেনে। দাদি রান্না করছেন। তাকে সাহায্য করছেন দাদু। বেশ ব্যস্ত। দু’জনকে হ্যালো বলল তারা। মাথা ঝুঁকিয়ে সাড়া দিলেন তারা। কিচেন থেকে বেরিয়ে বিশাল ডাইনিং রুমে গিয়ে বসে পড়ল খুদে বাহিনী। একটু পরই দাদি প্লেট ভর্তি স্যান্ডউইচ এনে রাখলেন টেবিলে। পেছনে এলেন দাদু। তার হাতে বড় জগ। ফলের রস ভরা।


নীরবতার মধ্যে খাওয়া শেষ হয়। ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না ঘরটিতে।

আমরা এগুলো ধুয়ে দিচ্ছি দাদি, বলল ন্যান্সি।

তার কথা শেষ হতে এগিয়ে আসে অন্যরা। কাপ-পিরিচ-ডিশগুলো কিচেনে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে ফেলে তারা। তারপর জায়গামত রেখে দেয়।

এবার সবাই গিয়ে জড়ো হয় কমান্ডার কুর্টের ঘরে। বন্ধ করে দেয় দরজা। ন্যান্সি আর লিন দখল নেয় বিছানার। আর ছেলেরা পা ছড়িয়ে বসে মেঝেতে। কুর্ট বলে-

শোনো সবাই। কাল যদি আবহাওয়া ভালো থাকে তাহলে ব্রেকফাস্ট করেই আমরা বেরিয়ে পড়ব অভিযানে। সৈকতের পুবদিকের শেষপ্রান্তের গুহাগুলোই আমাদের লক্ষ্য। এসব গুহায় আমরা আগে যাইনি। তাই জায়গাটা চিনি না বললেই হয়। আমরা গুহাগুলো ঘুরে দেখব। বলা যায় না, পুরনো কোনো কিছু হয়ত পেয়েও যেতে পারি। তাহলে কী মজাই না হবে, তাই না?

সমর্থনের আশায় কথা থামিয়ে অন্যদের দিকে চাইল সে। দেখল, সবারই চোখ জ্বলজ্বল করছে। তার মানে এতে কারো আপত্তি নেই। ফাইন। বলল-

আমাদের এতে সময় লাগতে পারে। তাই বেশি সময় পাওয়ার জন্য ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়তে হবে। ফিরতে হবে দুপুরে লাঞ্চের আগেই। নইলে দাদু-দাদি রাগ করতে পারেন। সেটা ভালো হবে না।

 দরকার কী! বিজ্ঞের মত বলে ওঠে ন্যান্সি। দাদু-দাদিকে বলব যে আমাদের একটু দেরি হতে পারে। ফিরে আসার পর খাবো। কিন্তু দরকার হলে আমরা আজ সৈকতে লাঞ্চ করব। সে জন্য হালকা কিছু খাবার সাথে নিতে হবে।

ভালো বলেছিস তো! প্রশংসার চোখে ন্যান্সির দিকে তাকায় কুর্ট। তাহলে সকাল আটটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব আমরা, কেমন? আজ ডিনার সেরে সকাল সকাল শুয়ে পড়তে হবে সবাইকে। ঠিক আছে?

 ঠিক আছে। এক সাথে বলে ওঠে বাকি সবাই।


(চলবে)