৪.
পড়ে গিয়ে একটু সময় চুপ করে শুয়ে থাকে ডেভ। তারপর পড়ে যাওয়া কাঠের টুকরোটা তুলে নিয়ে গুহামুখের দিকে হাঁটতে শুরু করে। সেখানে ন্যান্সি আছে। ডেভের যাওয়ার পর খানিকটা অপেক্ষা করে কুর্ট। এতক্ষণে ন্যান্সির কাছে সে পৌঁছে গেছে বলে অনুমান করে সে। বাকি ক’ টুকরো কাঠ, সবটা দড়ি আর ক্যানভাসের টুকরোগুলো এক সাথে করে কাঁধে তুলে নেয় কুর্ট। লিনকে ঐ লোকগুলোর কাছে একা রেখে বেরিয়ে আসে। তার খারাপ লাগছিল খুব। ফিসফিস করে নিজেকে শোনায়- লিনকে উদ্ধার করতে দ্রুত ফিরে আসব।
গুহার বাইরের উজ্জ্বল সূর্যালোকে দাঁড়িয়েছিল ওরা দু’জন। কুর্টকে দেখে জিজ্ঞেস করে ন্যান্সি-
: লিনকে মুক্ত করার কথা কী ভাবছিস?
: আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। ড্রাগন বানাতে হবে।
: কি বলছিস, ড্রাগন দিয়ে কি হবে? আর তা বানাবই বা কিভাবে? প্রশ্ন করে বিস্মিত ন্যান্সি।
কুর্ট বলে-
: এখন কথা বলার সময় নেই। চল, কাজ শুরু করি।
সব কাঠ, ক্যানভাসের টুকরো আর দড়ি মিলিয়ে একটা ড্রাগন বানানোর কাজ শুরু করে ওরা।
খানিকটা সময় পর ড্রাগনের কাছাকাছি দেখতে কিছু একটা তৈরি হয়ে যায়। একটু দূরে গিয়ে তৈরি করা জিনিসটিকে পরখ করে দেখে ওরা।
: চলনসই একটা ড্রাগন, কি বলিস তোরা?
ন্যান্সি আর ডেভ সায় দেয় তার কথায়।
হাতের ঘড়িতে সময় দেখে কুর্ট। প্রায় দশটা। বলে-
: চল, এখন আমরা বাড়ি ফিরে যাই। সারাদিন আর এখানে আসা হবে না। সন্ধ্যা হলে লিনকে উদ্ধার করতে আমাদের অভিযান শুরু হবে।
তার কথায় চমকে ওঠে ন্যান্সি-
: কী বলছিস তুই? লিনকে ঐ খারাপ লোকগুলোর হাতে ফেলে আমরা চলে যাব? আর রাতে আমরা ওকে উদ্ধারই করব কিভাবে? এখুনি পুলিশের কাছে চল।
: থাম। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ ব্যাপারটা। আমরা যদি লিনের আটক হওয়ার কথা দাদুকে জানাই সাথে সাথে পুলিশকে জানাবেন তিনি। বাবা-মাও জেনে যাবেন সব। আমাদের এখানে আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। আর পুলিশকে খবর দিয়ে আনতে আনতে কমপক্ষে এক ঘন্টা লেগে যাবে। তাদের মনে যদি খারাপ ইচ্ছা থাকে তাহলে লিনকে এর মধ্যে অন্য কোথায়ও সরিয়ে ফেলতে পারে, সে সাথে সবাই পালিয়েও যেতে পারে। তখন ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে। আর এখন যদি লিনের খোঁজে কেউ না যায় তাহলে ব্যাপারটাকে তারা গুরুত্বই দেবে না। তা ছাড়া ক্ষতিকর কেউ নয় ভেবে ওকে ছেড়েও দিতে পারে।
বড়জোর আটকে রাখবে। আমার মনে হয়েছে, এটা ওদের নিরাপদ আস্তানা। এখানেই থাকবে তারা। সন্ধ্যায় আমরা আসব।
কুর্টের যুক্তি একেবারে ফেলে দেয়ার মত নয়, ভাবে ন্যান্সি। কিন্তু লিন এখানে থাকবে ভাবতেই ভয় হচ্ছে তার। রাতে এসে যদি লিনকে উদ্ধার করতে না পারে তখন কী হবে?
কুর্টকে কথাটা বলার পর ও বলে-
: তখন বাধ্য হয়ে পুলিশকে জানাতেই হবে।
: কিন্তু দাদু আর দাদি লিনকে না দেখে তো জানতে চাইবেন তার কথা। তখন? ডেভ জিজ্ঞেস করে।
এর জবাব দেয় ন্যান্সি-
: বলব যে মাথায় ব্যথা হয়েছে বলে লিন ঘরে ঘুমাচ্ছে। এখন বড় কথা যে এ ড্রাগনটিকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে।
কুর্ট আশপাশ ঘুরে দেখতে যায়। মিনিট দশেক পর ফিরে আসে সে। খুশিভরা গলায় বলে, পেয়েছি।
গজ পঞ্চাশেক দূরে দু’টিলার মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে এসেছে। তার মধ্যে তাদের কাঠ-কাপড়ের এ প্রাণহীন ড্রাগনটাকে লুকিয়ে রাখা যাবে। এদিকে লোকজন আসে না। অতএব ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত এটা ঠিক থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়।
ওরা বাড়ি ফেরার পর কোনো সমস্যা হলো না। লিন যে নেই, তা দাদু আর দাদি খেয়ালই করলেন না। লাঞ্চের পর ওরা জড়ো হল কুর্টের ঘরে। শুরু হল আলোচনা। কে জানে লিন এখন কেমন আছে। ঐ লোকগুলো তাকে কিছু খেতে দিয়েছে কি না। তবে বড় কথা হচ্ছে, ওরা তাকে উদ্ধার করবে কিভাবে, আর কখন রওনা হবে। কুর্ট ততক্ষণে একটা পরিকল্পনা ছকে ফেলেছে।
: রাত ঠিক সাড়ে আটটায় রওনা হব আমরা। সবার কাছে একটা করে টর্চ থাকবে যাতে অন্ধকারে কোনো অসুবিধা না হয়।
ঠিক সময়ে কোনো শব্দ না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে তারা। ওরা জানে, দাদু বা দাদি কেউই ওদের খোঁজ করবেন না। একবার বেডরুমে ঢুকলে সকালের আগে আর ঘর থেকে বের হন না তারা। বাইরে বেরিয়ে দেখল, আকাশে চাঁদ উঠেছে। বেশ আলো ছড়াচ্ছে। তাই টর্চ জ্বালানোর দরকার হলো না। সৈকতে পৌঁছে যায় ওরা।
জিজ্ঞেস করে ন্যান্সি-
: আচ্ছা, তোর প্ল্যানটা কী? একটু বল আমাদের।
: আমরা এখন ড্রাগনটা নিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকব। আমার ধারণা যে রাতের বেলা গুহার মধ্যে ড্রাগনের মত কিছু দেখে ওরা ভয় পাবে এবং পালাবে। তখন লিনকে নিয়ে আমরা বেরিয়ে আসব। তবে এ লোকগুলোর ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। ওরা যেন আমাদের ধরতে না পারে।
কাঠ, ক্যানভাস ও দড়ি দিয়ে ড্রাগনের মত যে জিনিসটা কুর্ট বানিয়েছিল তা প্রায় ছয় ফুট লম্বা। কাঠের কাঠামোর ওপর এটা তৈরি। পুরো কাঠামো ক্যানভাসে ঢাকা। মুখটা কদাকার, দু’দিকে কাঠের টুকরো দিয়ে হাত তৈরি করা হয়েছে। ফ্রেমের ভেতরটা এমন করে বানানো যে প্রয়োজনে দু’জন সেখানে বসতে পারবে। সেটাকে ধরে বাইরে নিয়ে আসে তারা। কুর্ট বলে-
: ডেভ, তুই এর ভেতরে বসবি। আর আমরা দু’জন এটাকে টেনে নিয়ে যাব গুহার মধ্যে। এটা দিয়ে ভয় দেখিয়েই ওদের কাছ থেকে লিনকে উদ্ধার করব আমরা।
ডেভ ড্রাগনের ভেতরে গিয়ে বসে। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছে সে।
গুহার ভেতরে ঢোকে ওরা। আস্তে আস্তে হাঁটছে, চোখ খাপ খাইয়ে নিচ্ছে অন্ধকারে। কিছুটা এগিয়ে থেমে যায়। সামনে আগুন জ্বলছে । বেশ কিছু লম্বা কাঠ দিয়ে জ্বালানি হয়েছে আগুন। মনে হয়, কয়েকটি কাঠের তক্তা মাঝখানে ফেড়ে নেয়া হয়েছে। আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয়, ঠান্ডা তাড়াতেই এ আগুনের ব্যবস্থা। কুর্টের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। জ¦লন্ত কাঠগুলো থেকে দু’টি তিন-চার হাতের মত লম্বা টুকরো তুলে আনে। সেগুলোর আগুন না জ¦লা দিকটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে ড্রাগনের উপরের দিকের দু’পাশে। এতে ড্রাগনের চেহারাটা আরো ভীতিকর হয়ে ওঠে। হঠাৎ এটাকে দেখলে যে কেউই ভাববে যে ড্রাগনের দু’চোখ থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে। তাতে তারা ভয় পেতে পারে।
ড্রাগন নিয়ে খানিকটা এগিয়ে যেতেই দু’ জন লোককে দেখতে পায় ওরা। দু’টি মাঝারি আকারের পাথরের ওপর বসে আছে। মাঝে মাঝে গুহার পথের দিকে চেয়ে দেখছে। পাহারায় রয়েছে হয়ত। কুর্টের মনে হলো, লোক দু’টি তেমন সতর্ক নয়, কেমন যেন ঢিলেঢালা ভাব তাদের মধ্যে। কে জানে, নেশা করেছে হয়ত। হঠাৎ সামনে ড্রাগন দেখে ভড়কে যায় তারা। ভয়ঙ্কর দানবটা অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। আগুনের শিখায় বোধ হয় পুড়িয়ে মারবে ওদের। প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায় তারা। দৌড় দেয় কোনো কথা না বলে। মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
[চলবে]
0 coment rios: